ভোট একমাত্র সমাধান, আন্দোলন চলবে: খালেদা
‘যৌক্তিক পরিণতিতে’ না পৌঁছানো পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে ‘কষ্ট স্বীকার করে হলেও বৃহত্তর স্বার্থে’ এই কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার জন্য নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
৫ জানুয়ারি নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিনে ডাকা টানা অবরোধের ৬৭তম দিনে নিজের গুলশানের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে আসেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া, যার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলায় আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
তিনি বলেন, “শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং একের পর এক উসকানিমূলক আচরণ করে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটানো হচ্ছে। কাজেই যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছানো না পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।”
প্রায় ৪৫ মিনিটের এই সংবাদ সম্মেলনে দেশকে ‘ধ্বংসের হাত থেকে’ রক্ষা করতে তিনটি দফায় পুরনো দাবিগুলোই নতুন করে তুলে ধরেন ২০ দলীয় জোটনেত্রী খালেদা, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করে যিনি এখন অনেকটাই নাজুক পরিস্থিতিতে আছেন।
তার তিন দফা হলো-
ক. ‘আন্দোলন দমনের জন্য’ সারাদেশে বিরোধী দলের যে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে।
খ. ‘গুম, খুন ও বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ড’ বন্ধ করতে হবে। পুলিশি ও যৌথ বাহিনীর হয়রানি বন্ধ করতে হবে। নেতাকর্মীদের বিরেুদ্ধে দায়ের ‘হয়রানিমূলক সব মিথ্যা মামলা’ প্রত্যাহার করতে হবে। বিচারবহির্ভূত প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে হবে।
সেই সঙ্গে সভা-সমাবেশ মিছিলসহ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর আরোপিত ‘সব প্রকার বিধিনিষেধ’ অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
গ. ‘সবার কাছে গ্রহণযোগ্য’ সরকারের অধীনে সকলের অংশগ্রহণে অবিলম্বে জাতীয় সংসদের ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দ্রুত সংলাপের আয়োজন করতে হবে।
খালেদা জিয়া বলেন, “আমাদের বিশ্বাস এই প্রক্রিয়াতেই আমরা সমস্যা সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।”
দুই মাসের বেশি সময় ধরে লাগাতার অবরোধ ও হরতালে জনদুর্ভোগ, বিএনপির আন্দোলন কৌশল এবং খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রচুর প্রশ্ন থাকলেও লিখিত বক্তব্যের পর খালেদা জিয়া কোনো প্রশ্ন নেননি।
সংবাদ সম্মেলন শেষে পুলিশ ও কার্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষীরা মিলে সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের বের করে দেন।
অন্যদের মধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান, বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস ও মাহবুব আলম ডিউক এবং মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
‘হাসিনাকে বিশ্বাস ভুল ছিল’
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতেই বিএনপি ও শরিকরা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা দেয়। ভোট ঠেকাতে তাদের আন্দোলনে ব্যাপক সহিংসতায় সারা দেশে নিহত হন শতাধিক মানুষ।
বিএনপিহীন ওই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েই টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে বিজয়ের পর ‘জামায়াতের সঙ্গ ও সহিংসতা’ ছেড়ে আলোচনায় আসার জন্য খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু পরে বিএনপির সঙ্গে সব ধরনের সংলাপের সম্ভাবনা তিনি নাকচ করে দেন।
খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “ওই মহা কারসাজির নির্বাচনী প্রহসনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে এটি একটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। শেখ হাসিনা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে একটা সমঝোতা হলে সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের অঙ্গীকারও করেছিলেন।
“কিন্তু যথারীতি তিনি তার সেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছেন। আসলে প্রতিশ্রুতি রক্ষার কোনো দৃষ্টান্ত তাদের নেই।”
ওই নির্বাচনের পর বিএনপি ও শরিকরা নতুন কর্মসূচি না দিলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত হয়ে আসে। কিন্তু নির্বাচনের বর্ষপূর্তি ঘিরে খালেদা জিয়া নতুন করে আন্দোলনের ঘোষণা এবং তা ঠেকাতে ক্ষমতাসীনদের কঠোর অবস্থানের কারণে অস্থিরতাও ফিরে আসে।
শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতির কারণেই বিএনপি জোট নির্বাচনের পর আন্দোলনের কর্মসূচি স্থগিত করেছিল দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, “শেখ হাসিনার কথা বিশ্বাস করে আমাদের সেই সিদ্ধান্ত নেয়া যে সঠিক ছিল না, তা আমরা অচিরেই বুঝতে পারি।”
‘সংকটের মূল উৎস’
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সমালোচনা করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর-এর মধ্য দিয়ে যে কোনো পদ্ধতিই সংশোধিত ও পরিশোধিত হতে পারে। প্রয়োগের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় পরিলক্ষিত ত্রুটি-বিচ্যুতিও ঐক্যমতের ভিত্তিতে সংশোধনের সুযোগ ছিল এবং উচিত ছিল সেটাই করা।”
গত মহাজোট সরকারের সময় ওই সংশোধনীর ফলে ‘শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক ও স্বাভাবিক পন্থায়’ ক্ষমতা হস্তান্তরের সব পথ ‘প্রায় রুদ্ধ’ করে ফেলা হয়েছে মন্তব্য করে এ বিষয়টিকেই ‘সব সংকটের মূল উৎস’ হিসাবে তিনি চিহ্নিত করেন।
এর আগে গত ৩১ ডিসেম্বর আরেক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি জোটের সাত দফা দাবি তুলে ধরার কথা মনে করিয়ে দিয়ে খালেদা বলেন, “তারা সঙ্গে সঙ্গে তা নাকচ করে দেয়। এই পরিস্থিতিতে সংকট নিরসন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং ভোটাধিকারসহ জনগণের সকল অধিকার ফিরিয়ে আনতে আন্দোলন ছাড়া আর কোনো পথ আমাদের সামনে খোলা রাখা হয়নি।”
গাজীপুরের জনসভাস্থলে ১৪৪ ধারা জারি, বালির ট্রাক দিয়ে কার্যালয়ে ‘অবরুদ্ধ’ করা এবং আদালতে হাজিরার দিকে বকশীবাজারে ‘ছাত্রলীগের হামলা’সহ বিভিন্নভাবে সরকার হেনস্তা করছে বলেও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
এর বিরুদ্ধে লড়াই না করলে ‘স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সাহসিকতার সঙ্গে সবাই অংশগ্রহণ করলে এ আন্দোলন অচিরেই সফল হবে ইনশাআল্লাহ। এই সাময়িক কষ্ট জাতির বৃহত্তর স্বার্থে স্বীকার করার জন্য আমি সকলের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।”
এই আন্দোলন করতে গিয়ে যারা ‘নিহত, আহত ও গুম’ হয়েছেন তাদের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রতি ‘সমাবেদনা’ জানিয়ে ‘দিন পরিবর্তন হলে’ তাদের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন খালেদা।
যেসব দেশ, সংগঠন, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ‘সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে’ সমস্যা সমাধানের কথা বলেছেন তাদেরও তিনি ধন্যবাদ জানান।
খালেদা বলেন, “একতরফাভাবে যে বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী তারা পাস করেছে তা তারা একতরফাভাবে বাতিলও করে দিতে পারে। তাতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পথ খুলবে। এই সংশোধনীর পর বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা পদত্যাগ করে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করলেই দেশে সংকটের অবসান ঘটবে।”
‘অপপ্রচারের কৌশল’
গত ৫ জানুয়ারি থেকে অবরোধ-হরতালের মধ্যে নাশকতা ও সহিংসতায় শতাধিক মানুষের মৃত্যুর জন্য সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খালেদা জিয়া ও তার দলকে দায়ী করে এলেও তিনি সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, আন্দোলন ঠেকাতে আওয়ামী লীগ ‘অপপ্রচারণার নোংরা পথ’ নিয়েছে।
তিনি বলেন, “রাজনৈতিক সংকট সমাধানের কোনো সদিচ্ছা এই সরকারের নেই। তারা সংকটকে দীর্ঘয়িত করতে চায়। সেই উদ্দেশ্যেই আন্দোলন চলাকালে তারা অন্তর্ঘাত ও নাশকতা চালিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে জঙ্গী তৎপরতা বলে দেশে-বিদেশে অপপ্রচার চালাচ্ছে।”
এতে ‘প্রকৃত জঙ্গীবাদীরা’ সুবিধা পাবে মন্তব্য করে সরকারকে হুঁশিয়ার করেন খালেদা জিয়া।
এই আন্দোলনে জনগণ বিএনপি জোটের সঙ্গে আছে দাবি করে তিনি যুক্তি দেন, সাধারণ মানুষকে বোমা মেরে ও পুড়িয়ে হত্যা করলে ক্ষমাতাসীনরা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে প্রচারণার সুবিধা পাবে।
“কাজেই ক্ষমতাসীনেরা সুবিধা পায় এমন কোনো অপকর্মে আমাদের কেউ জড়িত থাকার প্রশ্ন ওঠে না।”
‘বিশ্বাসযোগ্য’ তদন্তের মাধ্যমে এসব ঘটনার ‘প্রকৃত হোতাদের’ সনাক্ত করে কঠিন শাস্তির দাবি জানান খালেদা, যিনি নিজে নাশকতার অন্তত চারটি মামলার আসামি।
আন্দোলন দমনে ক্ষমতাসীনরা ‘নাৎসি কায়দায়’ নিজেরা অপরাধ ঘটিয়ে বিরোধীদের ওপর দায় চাপাচ্ছে অভিযোগ করে খালেদা বলেন, “হিটলারের যেমন শেষ রক্ষা হয়নি, তার অনুসারী বাংলাদেশি ক্ষুদে হিটলাররাও চূড়ান্ত বিবেচনায় পরাজিত হবে।”
দুর্নীতি মামলায় খালেদার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারের মন্ত্রীদের সাম্প্রতিক মন্তব্যের দিকে ইংগিত করে বিএনপি প্রধান বলেন, “ক্ষমতাসীনেরা প্রতিনিয়ত আমাকে জেল-জুলুম ও ফাঁসির ভয় দেখাচ্ছে। নানা ভাবে হেনস্তা করছে।
“এসবে কোনো লাভ হবে না। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সকলের অংশগ্রহণে দ্রুত একটি নির্বাচনের আয়োজন করলেই কেবল চলমান সংকটের সুরাহা হবে।”
ক্ষমতাসীনরা আলোচনা করতে না চাইলে সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব এককভাবে তাদের ওপরেই বর্তাবে বলেও মন্তব্য করেন খালেদা।
তিনি বলেন, “আজকের সংকটের সমাধানের চাবিকাঠি ক্ষমতাসীনদের হাতে। সংকট নিরসনের মাধ্যমে তারা কাঙ্ক্ষিত জাতীয় ঐক্যের পথ খুলে দিতে পারে। তাহলে আমরা সংকট মুক্ত হয়ে এবার সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতির ৪৫তম স্বাধীনতা দিবস পালন করতে পারব।’’
0 Comment